ইয়াবা শুধু জীবন কেড়ে নেয় না, আসক্তের পুরো পরিবারের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। চাকরিজীবীদের বেতনের টাকা, অবসরপ্রাপ্তদের পেনশনের টাকা, ব্যবসায়ীদের মুনাফাসহ মূল টাকা এবং বেকার যুবক-যুবতীদের মা-বাবার কষ্টার্জিত অর্থের টাকা শেষ করে নিচ্ছে ক্রেজি ড্রাগ হিসেবে পরিচিত মরণ নেশা ইয়াবা।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, দেশে ৭৭ লাখ মানুষ ইয়াবায় আসক্ত। দিনে দুটি করে ইয়াবা বড়ি তারা খায়। প্রতিটি বড়ির মূল্য ৩০০ টাকা। সেই হিসেবে দৈনিক ৪৬২ কোটি টাকার ইয়াবা খাচ্ছে আসক্তরা। আর আসক্তরা প্রতি মাসে ইয়াবা খাচ্ছে ৬ হাজার ৯৩০ কোটি টাকার। বিপুল অঙ্কের এই অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে।
অথচ এই মাদক গ্রহণের ফলে তারা নিজেদের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে, পরিবারের অর্থনীতিকেও করে দিচ্ছে পঙ্গু, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিভেদও সৃষ্টি হচ্ছে।
র্যাব ইয়াবা আসক্ত ও ব্যবসায়ীসহ জড়িত বিপুল সংখ্যক নারী-পুরষদের গ্রেফতার করেছে। তাদের ইয়াবা আসক্ত হওয়ার বক্তব্য, টাকার উৎস ও বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে র্যাব কর্মকর্তারা দেখেন যে, তারা দৈনিক এই বিপুল অর্থ ইয়াবা খাওয়ার পেছনে ব্যয় করে থাকে। র্যাবের অনুসন্ধানে উঠে আসে, শুধু আসক্তরাই ধ্বংস হচ্ছে না, তাদের পুরো পরিবারটা আর্থিক সংকটে পড়ে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বনিম্ন ব্যবহারের হিসাবে এই বিপুল পরিমাণ ইয়াবার চাহিদার তথ্য পাওয়া গেলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। হু হু করে ইয়াবাসেবীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর এই ইয়াবা প্রতিদিনই আসছে অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে। ইয়াবার সংকটেও পড়তে হয় না আসক্তদের।
দীর্ঘদিন টেকনাফে চাকরি করেছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একজন কর্মকর্তা জানান, টেকনাফের সীমান্তবর্তী এলাকার মাদক পাচারের পয়েন্টগুলোতে সর্বোচ্চ নজরদারি থাকলেও নানা কৌশলে ইয়াবার চালান আসছেই। মাছধরার জাল থেকে শুরু করে সাগরে ভাসতে ভাসতে ইয়াবার চালান আসছে দেশের ভিতর। কোনোভাবেই এই আগ্রাসন রোধ করা যাচ্ছে না। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত দেশের সর্বত্র মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়েছে নীরব এই ঘাতক। সব শ্রেণী-পেশার মানুষ এখন ইয়াবায় আসক্ত।
ইয়াবার সর্বনাশা থাবায় লাখো পরিবারের সন্তানদের জীবন এখন বিপন্ন। এমন সন্তানদের মায়ের কান্না এখন ঘরে ঘরে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে এই মাদকের চাহিদা বেড়েই চলেছে। দিনে চাহিদা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ পিসে। এই বিপুল সংখ্যক ইয়াবা প্রতিদিনই বিভিন্ন কৌশলে দেশে ঢুকছে। সেবনকারীরা প্রতি পিস ৩০০ টাকা করে ইয়াবা কিনে ব্যবহার করছে। মাদকসেবীরা ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছে এই বিপুল অঙ্কের টাকা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধ্বংস করে মাদক ব্যবসার এই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার কোটি টাকা।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবদেহের সবচেয়ে ক্ষতিকর নেশাজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে ইয়াবা অন্যতম একটি। ইয়াবা অর্থ হলো ক্রেজি মেডিসিন বা পাগলা ওষুধ। মেথ্যাম ফিটামিন, উত্তেজক পদার্থ ক্যাফিনের সঙ্গে হেরোইন মিশিয়ে তৈরি করা হয় ইয়াবা। এ নেশাদ্রব্য হেরোইনের চেয়ে ভয়াবহ বলে মনে করেন তারা। তাদের মতে, ইয়াবা সেবন করার পর মনে হতাশা, বিষাদ, ভয়, অনিশ্চয়তারও উদ্ভব হতে পারে। এ ছাড়া এটি আচরণগতভাবে সহিংস করে তুলতে পারে সেবীদের। চিকিত্সকরা আরো বলেন, ইয়াবা শুধু অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে না, আসক্তদের শরীর শেষ করে দিচ্ছে। আসক্তরা খুন-খারাবি থেকে শুরু করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলছেন, এক সময় ইয়াবাসহ মাদকাসক্তরা মরণ ব্যাধিসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। যা তাদের মৃত্যু অবধারিত।
উচ্চাভিলাষী পরিবারের একমাত্র সন্তান দিদার। এটি তার ছদ্মনাম। জীবনে কোনদিন সে অভাব দেখেনি। হাত বাড়ালেই মিলেছে টাকা। তাই খরচেও কোন কার্পণ্য ছিল না তার। খরচে কার্পণ্য পরিবারেরও পছন্দ না। একটা মাত্র ছেলে, যখন যেটা চেয়েছেন তখন সেটাই সামনে হাজির হয়েছে। মুখ থেকে উচ্চারণ করতে যতক্ষণ, ছেলের সামনে হাজির করতে বারণ নেই ব্যবসায়ী বাবার। ছোটবেলা থেকেই হাই সোসাইটিতে বসবাস। বন্ধু-বান্ধব মহলও গড়ে ওঠে হাই সোসাইটিতে। এরই মধ্যে ছেলের ইংরেজি মাধ্যম থেকে ও লেভেল শেষ। পরিবার সিদ্ধান্ত নিল, দেশে থাকলে ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে। তাই তাকে বিদেশে পড়তে পাঠানো হোক। যেই কথা, সেই কাজ। পাঠানো হলো ইংল্যান্ডে। ডিগ্রি শেষ করে দেশেও ফিরেছেন ঠিকঠাকভাবে। পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিলো তরুণের। স্বপ্নটা পরিবারেরও। পাইলট অবশ্য হয়েও গেছিলেন। তবে স্বপ্নে বাধ সাজলো নেশাদ্রব্য ইয়াবা। ইয়াবার পাল্লায় পড়ে তার সব স্বপ্ন ভেস্তে গেল। এখন সে পুরোদমে ইয়াবা আসক্ত। আট বছর ধরে ইয়াবা সেবন করছেন। এখন তার বয়স ৩৫। চিকিৎসায় বহু টাকা খরচ করেছে তার পরিবার। তবে কোন পরিবর্তন নেই। মাদক নিরাময় কেন্দ্রে আলাপকালে এভাবেই নিজের জীবনের চিত্র তুলে ধরেন যুবক।
ইয়াবার সাথে কিভাবে নিজেকে জড়ালেন জানতে চাইলে বলেন, দেশে ফেরার পর পুরাতন বন্ধু-বান্ধবের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। তারা প্রায়ই রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় আড্ডা দিতেন। বন্ধুদের কয়েকজন ইয়াবা আসক্ত ছিলেন। তাদের পাল্লায় পড়ে ইয়াবার সাথে নিজেকে জড়ান। প্রথমে একটা-দুটো। এভাবে ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে ওঠেন। বন্ধুরা তাকে বলতো, ইয়াবা খেলে শরীরে শক্তি থাকে। নিজেকে স্লিম এবং স্মার্ট লাগে। তোর পাইলট হওয়ার জন্য তোকে ফিট থাকতে হবে। একথা শুনে ইয়াবা সেবন করতে রাজি হই।
এখন দেশজুড়ে চলছে ইয়াবার বাজার। নতুন প্রজন্ম রীতিমতো ইয়াবার প্রেমে উন্মাদ। মাদকের বাজারে কেনাবেচার শীর্ষে রয়েছে সর্বগ্রাসী ইয়াবা। রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ইয়াবার অভিন্ন আস্তানা গজিয়ে উঠছে। মাদকটি আকারে ছোট হওয়ায় সহজে বহন করা যায়। এ কারণে অন্য মাদকের তুলনায় ইয়াবা সেবনকারী ও বিক্রেতারা খুব সহজে নিরাপদে সেবন ও বিক্রি করতে পারে। যারা ইয়াবা সেবন করে তারাই বিক্রির সঙ্গে জড়িত। আইনের চোখে ফাঁকি দেওয়ার জন্য সাংকেতিক নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাবা’।
এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় এটিকে নানা নামে ডাকা হয়। আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, দিন দিন ইয়াবায় আসক্ত তরুণীর সংখ্যা বাড়ছে। খারাপ ও বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে -মেয়েদের মাধ্যমে অনেকেই এই জগতে প্রবেশ করছে। অনেকে আবার সে ফ কৌতূহলের বশেও দু-একবার ইয়াবা সেবন করে স্থায়ীভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এদের অধিকাংশই স্কুল, কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ইয়াবার ভয়াবহতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে সরকারের দায়িত্বশীল সব মহলকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা রাত-দিন ইয়াবাবিরোধী অভিযানে আছেন। প্রতিদিনই হাজার হাজার পিস ইয়াবা জব্দ হয়। আটক হয় ইয়াবা পাচারকারী, বিক্রেতাসহ সেবনকারী। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। বন্ধ হচ্ছে না ইয়াবার স্রোত।